Bengali Short Story

ছাতা

বাসব রায়

– চরিত্র পরিচিতি –

রাম রায়  – কেরানি, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। সাধারণ জামা-প্যান্ট-চটি।

বিদ্যেধর   – পিওন, বয়স তিরিশ।

মাদারবক্স  – ছাতাসারাইওলা।

ছাতা     – পুরোনো আমলের বেশ বড়োসড়ো কালো ছাতা।

সন্ধেবেলা। আপিস গুটিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্‌যোগ করছেন রাম রায়।

রাম- (বিদ্যেধরের উদ্দেশ্যে) অ্যাই বিদ্যেধর, আমি বেরুলাম। ঝাঁপি ফেলে দিস বুঝলি। (ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন)

বিদ্যেধর- (ছাতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ) ছাতাটা ভুলে যাচ্ছেন স্যার, ছাতাটা।

রাম- ভালো মনে করালি রে ব্যাটা। আরেকটু হলে বিপত্তি হচ্চিল আর কী! (ফুটোনো ছাতাটা তুলে বন্ধ করতে গেলেন) কাল পরশু আবার ছুটি, আমার আবার এইটি মাত্তর সম্বল।

(ছাতা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না, বিস্তর ধস্তাধস্তি শুরু করলেন)

বিদ্যেধর- বন্ধ হচ্চে না বুঝি? দেখি আমি চেষ্টা করে, দেখি (ছাতাটা রামের হাত থেকে নিল)।

রাম- দেখিস বাপু, বেশী জোরজুলুম করিস নি, আমার ঠাকুর্দার ওই একটি মাত্তর স্মৃতি। হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেললে ঠাকুমা খুব দুঃখ পাবে!

(বিদ্যেধরও বন্ধ করতে পারে না)

বিদ্যেধর- কী এক খানা ঠ্যাঁটা ছাতা স্যার! কিছুতেই বাগ মানানো যাচ্ছে না। এর সঙ্গে ঘর করেন কী করে!(প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে)

রাম- (হতাশ)কী চরম অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স বল দিকি, কাল পরশু দুদিন ছুটি– কোথায় একটু খুশি মনে বাড়ি ফিরবো– তা না আচমকা ছাতার এই বে-আদপি! আমার জীবনেই এসব হতে হয় (উপরের দিকে চেয়ে)! আজ সকাল থেকেই শুরু হয়েচে বিপত্তি- তাড়াহুড়োয় টিফিনটা নিতে ভুলে গেলাম– তিরিশ টাকা গচ্চা দিয়ে ক্যান্টিনে লাঞ্চ সারতে হল। তারওপর ফেরার পথে শ্যায়ালদায় সস্তায় বাজার করব ভেবেছিলাম, বাজারের থলেটাও সঙ্গে আনতে ভুলে গেচি! খালি আমার জীবনেই অ্যাতো ট্র্যাজেডি– কোনো কাজটা স্বস্তিতে হবার নয় র‍্যা!

বিদ্যেধর- সত্যি খুব টেজেডি। ফুটোনো একখানা ছাতা নিয়ে এই বাদুড়ঝোলা আপিসটাইমে– আমি তো ভেবেই ভির্মি খাচ্চি স্যার! ট্রামে, বাসে কেউ নেবে না– দূর দূর করে দেবে! আর ট্রেনের গার্ডের চোখে পড়লে তো জি-আর-পি দিয়ে শান্টিং করিয়ে দেবে! এইসব ঝক্কি, তারওপর সক্কাল সক্কাল আবার ঘোষসাহেবের বকুনিও জুটেচে।

রাম- (রেগে গিয়ে) অ্যাই ব্যাটা কাফের! দে, দে ছাতাটা দে। বড্ড চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেচিস- ফিরিঙ্গি আমল হলে এই ফুটোনো ছাতা দিয়ে খুঁচিয়ে নিকেশ করে দিতাম– বুঝতিস ট্র্যাজেডি কাকে বলে!

বিদ্যেধর- (গায়ে না মেখে) স্যার, আমি বলছিলাম কী- আপিসের বাইরের যে মোড়টা, ওইখানে একটা ছাতাসারাইওলা বসে। ধন্বন্তরী একেবারে– ওকে গিয়ে দেখান না একবার। আমার সঙ্গে খাতির আছে- আমার নাম করবেন, দক্ষিণা কিছু কম হয়ে যাবে।

(রাম বিরক্ত মুখে ফুটোনো ছাতা নিয়ে বেরুলেন, বিদ্যেধর মুচকি মুচকি হাসতে লাগল)

দৃশ্যান্তর

রাস্তা। ছাতা সারাইওলা মাদারবক্স শেখ ভাঙাচোরা ছাতার গুষ্টি নিয়ে ব্যাজার মুখে বসে। চেহারায় বিজ্ঞ ভাব। রাম ফুটোনো ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। ছাতা মাথায় দেবেন, না হাতে ঝুলোবেন– এই নিয়ে বিস্তর দ্বিধা।

রাম – এইটে একটু দেখো তো ভাই।

মাদারবক্স – (ছাতাটা হাতে নিয়ে) ফজজুল হকের আমলের ছাতা কত্তা, এদের কতা কেতাবে বহুত পড়েচি– দেখার সুযোগ এই প্রথম হল।

রাম – (কিঞ্চিত গর্বিত) হেঁ হেঁ আমার ঠাকুর্দা শ্রীরামগোবিন্দ রায়ের ছাতা, ফিরিঙ্গি আপিস থেকে রিটায়ার করার সময় দিয়েছিল আপিসের লোকজন।

মাদারবক্স – হুম। তা কী পবলেম ছার?

রাম- ফুলের মতো ফুটে আছে- আর কিছুতেই বন্ধ হচ্চে না। বৃষ্টি থাকুক নাই বা থাকুক – ছাতা ফুটন্ত!

মাদারবক্স – (ছাতাটি নিরীক্ষণ করে)হুম। খচ্চা আছে।

রাম – কী রকম?

মাদারবক্স – এইসব পুরনো মডেলের ছাতার ব্যামো সারানো সহজ না ছার।

রাম – তাও?

মাদারবক্স – তার ওপর আমাদের কাজ বন্ধ ছাতাকে ফুটিয়ে দেওয়া, ওটাই ধম্ম আমাদের। ফুটোনো ছাতা বন্ধ করার কাজটা ট্যাড়া- অধম্ম, তাই খচ্চাও বেশী লাগে।

রাম – ধম্মের কথা রাখো, রাম রায়কে ধম্ম শিখিও না! কত নেবে খুলে বল।

মাদারবক্স – পঞ্চাশ টাকা!

রাম- পঞ্চাশ টাকা!

মাদারবক্স –  এজ্ঞে পঞ্চাশ টাকা!

রাম – ভাই, এই ভরসন্ধেয় বেকায়দায় পড়েচি বলে এই রকম জুলুম করবে?

মাদারবক্স – জুলুম তো আমাদের উপর হচ্চে কত্তা। একটু পরেই তোলা নিতে আসবেন বাবুরা, সেই খরচাটাই সারাদিনে তুলতে পারিনি কো।

রাম – তুমিও তো ভাই তোলা-ই তুলচ খদ্দেরের কাছ থেকে – এটাও তো তোলাবাজি। (পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে) বড়োভাইজানের কথা রাখো, এই নাও দুটাকা। সেরেফ হাঁ মুখটা একটু বন্ধ করে দাও।

মাদারবক্স – ভিখিরি ঠাওরালেন কত্তা, দু’টাকায় এই কাজ হয়! কমসে কম তিরিশটাকা লাগবে, তার কমে হবে নি কো।

রাম – পাঁচ টাকা? পাঁচটাকায় হবে না?

মাদারবক্স – কেন মাথা খাচ্চেন কত্তা, তিরিশের এক কড়ি কমেও হবে নি।

রাম – বটে! তিরিশ টাকা! তিরিশ টাকা! তুঘলকের মুলুক নাকি, তুঘলকের! মনে রেখো সুয্যি এখনো পশ্চিমে অস্ত যায়, বাঙলায় এখনো সবুজবাতি জ্বলে!  সারাবো না আমি ছাতা। ফুটোনোই থাক, সারাজীবন ফুটেই থাক ওটা। বাজারের থলি আনিনি আজ, ওই ফুটোনো ছাতাতেই  বাজারভর্তি করে আজ আমি বাড়ি ফিরব!

ফ্রিজ। সমাপ্ত।

Share With Friends

Article Comments

Scroll to Top