Bengali Creative Writing - Puja

বং নাকে পূজোর গন্ধ

কাল তনুকার মেসেজটা দেখে হেসে ফেলে ঝিমলি কি মিষ্টি একটা নাক, নাকটা উঁচু করে গন্ধ নিচ্ছে। কি গন্ধ নিচ্ছে? পূজো পূজো গন্ধ যে গন্ধ নাকি স্পেশালি বংরা পায়। সত‍্যি তো বর্ষা কাল পেরোতেই বংদের টিকোলো নাকে, বোঁচা নাকে আসতে থাকে পূজোর গন্ধ। ঝিমলির পূজো পূজো অনেক দিন শুরু হয়ে গেছে ফেসবুক আর হোয়াট্স আ্যপে। তনুকা ঝিমলির প্রাণের বন্ধু এখন দিল্লীতে, বেশ কিছুদিন আগে গেছে পোষ্ট ডক করতে। দিল্লীতে থাকলেও বং ললনা তনুকা নাক উঁচু করে কলকাতার পূজোর গন্ধে গন্ধে একদম হাজির কলকাতায়।

আজকাল কি সুন্দর সুন্দ‍র ইমেজ পাঠায় বন্ধুরা , কখনও মা ছানাপোনা কোলে নিয়ে নৌকোয় পাড়ি দিয়েছেন, কখনও বা মায়ের মুখের নীচে ছড়ানো শিউলি ফুল। বেশ ভালো লাগে সকালে উঠে কাশফুল আর শিউলিফুলের মাঝে মাকে দেখতে। মায়ের সাথে যতই শপিং করুক ঝিমলি তবুও পূজোর আগে হাতিবাগান, গড়িয়াহাট আর দক্ষিণাপনে বন্ধুদের সাথে না ঘুরে ঘুরে বেড়ালে পূজোর শপিংটা ঠিকঠাক হয়না বলতে গেলে গন্ধটা ঠিক জমেনা। তারপর তনুকা এসেছে ঝিমলিকে পায় কে?
আজ সকালেই তনুকার মেসেজ, ‘এই ঝিমলি কাল তো মহালয়া বেরোবি নাকি ভোরবেলা?’ ‘কেন রে ?’ জিজ্ঞেস করে ঝিমলি? ‘আরে চলনা তোর বং নাকে একটু স্পেশাল পূজোর গন্ধের ছোঁয়া দেবো। আন্টির পারমিশানটা একটু নিয়ে রাখিস প্লিজ।’

পরদিন ভোরবেলা ঝিমলি একদম তৈরি, না হয়ে উপায় আছে? ভোর চারটে থেকে জ্বালাচ্ছে তনুকাটা, টেক্সটের পর টেক্সট। সাদা ধবধবে চিকনের কুর্তি আর নক্সিকাঁথার লাল ওড়নায় স্নিগ্ধ লাগছে ঝিমলিকে। ভোর পাঁচটায় ঠিক হাজির তনুকা ওর ব্লু ইঅন ড্রাইভ করে, ব‍্যাস আর কি ঝিমলি মাকে আর বাবাকে আদর করে বসে পড়ে তনুকার পাশের সীটে, সুধা বলতে থাকেন, ‘শোন তনু সাবধানে ড্রাইভ করবি বুঝেছিস আর কিছু স‍্যান্ডউইচ আর মিষ্টি দিয়ে দিয়েছি খেয়ে নিস কিন্তু।’ তনুকা গাড়ীতে স্টার্ট দেয় , ‘বাইইই আন্টি।’ ‘আরে বলেতো যা কোথায় যাচ্ছিস।’ ‘পূজোর গন্ধ নিতেএএএ।’ সুধা হেসে ফেলেন।

এফ এম অন করে দেয় তনু তখনও একটা চ‍্যানেলে মহালয়া হচ্ছিলো। সত‍্যি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চন্ডীপাঠ শুনে মা ও বোধহয় মর্ত‍্যে না এসে পারেন না। এত ভোরে এমন করে কলকাতাকে অনেকদিন দেখেনি ঝিমলি। রাস্তায় আজ লোকজনের বেশ আনাগোনা, অনেক ভোর থেকেই আজ গঙ্গার ঘাটে ভীড়। পিতৃপক্ষের অবসানে আর দেবীপক্ষের শুরুতে আজ যে পিতৃপুরুষকে জল দেবার দিন। ঝিমলির বাবাও তো আজ যাবেন গঙ্গায়।

আরে ঐ তো ঠাকুর যাচ্ছে , কিন্তু মুখটা ঢাকা। ওমা মায়ের সাথে গণেশ ,লক্ষী,কার্তিক,সরস্বতী সবাই যাচ্ছে তবে ওরা পেছনের গাড়ীতে। কি সুন্দর লাগছে। ঝিমলি আনন্দে বলে ওঠে,’ঐ দ‍্যাখ তনু আরেকটা ঠাকুর, সিংহটা কত্ত বড়। হা হা অসুরটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে, দ‍্যাখ দ‍্যাখ।’
লুকিং গ্লাসে চোখ রাখে তনুকা, হেসে বলে সত‍্যি তো। ঐ দ‍্যাখ দেশপ্রিয় পার্কের প‍্যান্ডেল, ওদের এবার কি থিম জানিস? জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় ঝিমলি দেখার চেষ্টা করে প‍্যান্ডেলটা। বকুনি দেয় তনুকা,’ এই যে বং সুন্দরী ,পূজোর গন্ধ নিতে গিয়ে নাকটাই যদি কাটা যায় তবে আর কি দিয়ে গন্ধ নিবি শুনি?’ হাসতে হাসতে বাড়ানো মুখটাকে গাড়ীর ভেতরে করে ঝিমলি।

খুব স্মার্ট লাগছে তনুকা কে আজ আকাশী নীল টপ আর ব্লু জিন্সে। ঝিমলি নাক উঁচু করে আজ ভোরের শিউলির গন্ধ নিচ্ছে আর বক বক করেই যাচ্ছে। ঐ দ‍্যাখ তনু রাস্তার ওপরের প‍্যান্ডেলটা কি কিউট! ওমা এখানে ঠাকুরও এসে গেছে। তনুকা হাসতে হাসতে বলে ,’ ও বঙ্গললনা তোমার বকবকুম থামাও দেবী, আমায় আর জ্বালাসনে এবার গাড়ী গিয়ে প‍্যান্ডেলে ধাক্কা দেবে।’ হাসতে থাকে ঝিমলি,ইস এই তোর পাকা হাত?

ঢাকুরিয়া ব্রীজে ওঠার মুখে একটু সাইড করে গাড়ীটা তনু,মুখ বাড়িয়ে বলে উঠে আয়, একদম পারফেক্ট টাইমে এসে গেছি বল। ঝিমলি অবাক হয়ে তাকায় ,তনুকা বলে, ‘রুদ্র ,আমার সাথেই রিসার্চ করে জে এন ইউ তে। আর রুদ্র, এই হচ্ছে আমার বক বকুম বং সুন্দরী সখী ঝিমলি। রুদ্রকে তুলে নিয়ে এবার স্পীড বাড়ায় তনু। ভোরের মিস্টি গন্ধ আর পূজো পূজো আমেজে চোখ বুজে আসে ঝিমলির, হঠাৎই চমক ভাঙে হাইওয়ে ছাড়িয়ে গাড়ী ঢুকছে গ্ৰামের মধ‍্যে, কি সুন্দ‍র সবুজে সবুজ চারিদিক!ভোরের সূর্যের আলোয় স্নান করে প্রকৃতি যেন সেজে উঠেছে মা উমার আগমনের প্রতীক্ষায়।

-আমরা কোথায় যাচ্ছি রে?
-ধৈর্য্য সখী, এক্ষুনি দেখতে পাবি। গ্ৰামের পথ ধরে গাড়ী এসে পৌঁছয় রূপনারায়ণের ধারে রূপনারায়ণপুরে, রুদ্রই এই রাস্তাটুকু ড্রাইভ করে নিয়ে এলো। নদীর ধারে কাশফুল দেখে ছুট লাগায় ঝিমলি গাড়ী থেকে নেমে।ইশ্ কি সুন্দর লাগছে! হাত দিয়ে একটু ছুঁয়েই শরতের হিমের পরশ পায় কাশফুলের গায়ে। ওর পাগলামি দেখে তনুকা হেসে ফেলে, সত‍্যি ঝিমলিটা এখনও ফুলের মত সুন্দর আর ছেলেমানুষ।

ঝিমলির হাত ধরে হাঁটতে থাকে তনু পাশে রুদ্র,মাধবীলতায় মোড়ানো একটা গেটের সামনে দাঁড়ায় ওরা,ভেতরে অনেকটা বাগান পেরিয়ে কি সুন্দ‍র একটা টিনের চালার বাড়ী, এমন বাড়ী দেউলটিতে দেখেছিলো ঝিমলি কথাসাহিত‍্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ‍্যায় এর বাড়ী। ওরা বাগান পেরোতেই শুনতে পায় দরাজ গলার ডাক, “এসো এসো দাদুভাই”, কইগো দেবী এদিকে এসো দাদুভাই যে সঙ্গে করে কাশফুল আর শিউলিফুল ও এনেছে, দেখে যাও।

এগিয়ে যায় রুদ্র তার সাথে ওরাও, রুদ্র বলে আমার দিম্মা আর দাদুভাই। প্রণাম করে ওরা সবাই। দিম্মার হাতের সাজিতে ভরা শিউলি আর স্থলপদ্ম। ঝিমলি আর পারেনা বলে ওঠে,’ও দিম্মা আমিও কুড়োবো শিউলি’। হেসে ফেলেন দাদু আর দিম্মা,’যা না দিদিভাই এখনও কত ফুল গাছতলায়।’
তনুকা আর ঝিমলি ছুটে যায় বাগানে,রুদ্র গল্প করতে বসে দাদুভাই এর সাথে। শিউলি কুড়িয়ে গন্ধ নিতে নিতে বং নাকে পুরোপুরি আসে মিষ্টি মিষ্টি পূজোর গন্ধ। স্থলপদ্মের গাছের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় ওরা, ওমা! কি সুন্দর দূর্গার কাঠামো একচালাতে, প্রায় তৈরী হয়ে এসেছে। চোখ জুড়িয়ে যায় ওদের। দৌড়ে এসে বলে,’ও দিম্মা তোমরা দূর্গা পূজো করো নাকি? দিম্মা হেসে বলে ওই মা দূগ্গা তো আমার বানানো রে। কৃষ্ণনগরে পাল পাড়ায় ছিলো আমার বাপের বাড়ী। ছোট্ট থেকেই ঠাকুর বানাই আমি, না বানিয়ে পারিনারে দিদি। এত কিছু একা কি করে করো দিম্মা? একা কোথায় রে মা দূগ্গা আমায় হাজার হাত দিয়েছে রে। রুদ্র হাসে তনু আর ঝিমলির অবাক মুখ দুটো দেখে।
সত‍্যিই তাই বেলা বাড়তে বাড়তে দিদার হাজার হাতেরা আসতে লাগলো, দিদা গ্ৰামের মেয়েদের স্বনির্ভর হতে শেখান। কেউ বা দেয় গয়না বড়ী , কেউ তোলে কাপড়ে নক্সা আবার কেউ বানায় জ‍্যাম, জেলি আর আচার। দাদু বাচ্ছাদের পড়ান, হাতের কাজ আঁকা শেখান। ওরা গাছ লাগায়, ফুল ফোটায় আপনমনে।

শ্রদ্ধা ভালবাসায় মাথা নুয়ে যায় ওদের। জীবন এত সুন্দর! এখানে না এলে তা হয়ত জানা হোতনা। ওদের জলখাবার, মিষ্টি দিয়ে দিদা বসেন দেবীর চক্ষুদান করতে নিরিবিলিতে। রূপনারায়ণের স্বচ্ছ জলে ঘট ভরে দেবীর সামনে স্থাপন করলেন। আজ ঝিমলিরাও দেখলো দেবীর মৃণ্ময়ী থেকে চিণ্ময়ী হয়ে ওঠা। এত মিষ্টি আমেজ বোধহয় কোন দিন পায়নি আগে।

দুপুরে খেতে বসে তনুকা বলে ওঠে দিম্মা এত কিছু!
আজ নিরামিষ দিদিভাই , তোমাদের দাদুভাই তর্পণ করে নিরামিষ খান।সরু চালের ভাত, সোনামুগের ডাল,শাক,শুক্তো,পাঁচরকমের ভাজা, গয়না বড়ি,মোচাঘন্ট, ধোকার ডালনা,চাটনি , পাপড়,পুষ্পান্ন,পরমান্ন অপূর্ব সব নিরামিষ পদ।

পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন রূপনারায়ণের বুকে অস্ত যায় যায় তনুকা আর ঝিমলি তখন দিম্মা আর দাদুভাইকে প্রণাম করে বলে , ‘আসি আমরা’। রুদ্র পূজোর কয়েকটা দিন দাদুভাইয়ের কাছেই থাকবে। দিম্মা আর দাদুভাই বলেন এসো কাশফুল আর শিউলিফুল। নবমীর দিন তোমাদের পথ চেয়ে থাকবো, বাড়ীর সবাইকে নিয়ে এসো।

ওরা এগিয়ে যায় গাড়ীর দিকে পেছনে হাত নাড়তে থাকে দাদু, দিম্মা, রুদ্র আর দিম্মার মেয়েরা । গাড়ীতে তনু বলে বং সুন্দরী কেমন লাগলো পূজোর গন্ধ? ঝিমলি বলে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো রে, সারাজীবন হয়ত এই গন্ধটা ভরিয়ে রাখবে আমাকে।

-সমাপ্ত-

(ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত – লেখিকা রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী)

Read more short stories.

Share With Friends

Article Comments

Scroll to Top