স্বামী , শাশুড়ি আর দেওর খেতে বসেছে । মাছের ঝোলের বাটিটা বয়ে আনতে গিয়ে কেমন মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো ইরাবতীর । মাথাটা যেন টাল খেয়ে গেল অল্প। কোনোমতে দেয়াল ধরে সামলাল নিজেকে। শরীরের আর দোষ কি ! সেই সকালে দুটো রুটি আর আলু পটলের তরকারি খেয়েছিল। এখন বেলা আড়াইটে বাজতে চলল , সেই খাবার কখন হজম হয়ে গেছে। বেজায় খিদে পাচ্ছিল সেই কখন থেকে। কিন্তু রান্না সারা না হলে খাবে কি করে ! ভারি পেট নিয়ে কাজ করতে বেশ কষ্ট হয় , তাই সময় লাগে একটু । শাশুড়িকে কষ্টের কথা বললেই উনি বলেন , একটু কষ্ট হলেও এ সময়ে নাকি কাজের মধ্যেই থাকতে হয়। শুয়ে বসে থাকলে বাচ্চার ক্ষতি হয়। তা কাজের মধ্যেই থাকে ইরাবতী । প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই , সে জানে।
মাছের ঝোল মুখে দিয়েই অজয় চেঁচিয়ে উঠলো ,
” কি বানিয়েছ এটা ? এত ঝাল দিয়েছ কেন ?”
” বুঝতে পারি নি । ঝাল বেশী হয়ে গেছে ? ” ভয়ে ভয়ে বলল ইরাবতী।
” তোমার মা কি তোমাকে রান্নাটাও শেখান নি ! কোনো কাজই তো পারো না ভালো করে। সামান্য কয়েকটা কাজ করতে সারাদিন লেগে যায় তোমার । হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে থাকো কুত্তার মত জিভ বের করে। মনে হয় লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিই। “
” এই অবস্থায় কাজ করতে গেলে কষ্ট তো একটু হবেই ! ” মৃদু প্রতিবাদ করে ইরাবতী ।
খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়ায় অজয়। রাগে মুখ লাল ওর । কেঁপে ওঠে ইরাবতী । অজয়ের এই রূপ চেনে ও । লাফিয়ে এসে ইরাবতীর চুলের মুঠি চেপে ধরে সে বলে ,
” এক তো কাজ করতে পারিস না। আবার মুখে মুখে তর্ক করিস ! দাঁড়া এই মাছের ঝোলটা তোকে খাওয়াবো পুরোটা । “
বাটিটা নিয়ে জোর করে ইরাবতীর মুখে উপুড় করে দিতে যায় অজয়।প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে টেবিলের কোণায় ধাক্কা খায় ইরাবতী । এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা শাশুড়ি মা মুখ খোলেন এবার।
” আহ ! অজয় , হচ্ছেটা কি ! ওর পেটে তোমার সন্তান , ভুলে যেও না । বাচ্চার ক্ষতি হয় , এমন কাজ করো না। “
ইরাবতীকে ছেড়ে দিয়ে অজয় বলে ,
” ওর মুখটা দেখলেই আমার মাথা জ্বলে যায় । ড্যাবা ড্যাবা চোখ , মোটা নাক, দাঁতগুলো দেখো , মনে হয় যেন কোদাল । ওহ ! কি করে ওকে পছন্দ করেছিলে মা ! “
” যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন এসব কথা বলে কি লাভ ! আয় , ঝোলটা খাস না , শুধু মাছ দিয়ে খেয়ে নে বাকি ভাত।’
অজয় খেতে বসতে শাশুড়ি ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে বলেন ,
” এখনও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন ? জানোই যখন অজয়ের চণ্ডাল রাগ , তখন বুঝে শুনে চলো না কেন বাপু ! একটু মন দিয়ে রান্নাটা করতে পারো না ! তাহলেই তো ভুল হয় না ! “
দেওরও খেতে খেতে বৌদির দিকে তাকিয়ে বলে ,
” বৌদির যে বুদ্ধি সুদ্ধি একটু কম আছে , সে আমি প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম।”
সব অপমান গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকে ক্ষুধার্ত ইরাবতী । এ বাড়িতে আসার পর থেকেই এমন অপমান সইতে সইতে ভেতরে ভেতরে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলেও কিছু করার উপায় নেই ইরাবতীর । অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ওর । মা বাবা বিয়ে দিয়েছেন কি আবার ওখানে ফিরে যাবার জন্য ? দাদার সংসারে ওঁদেরকেই প্রায় আশ্রিতের মত থাকতে হয় । সেখানে ইরাবতীকে কি করে আশ্রয় দেবেন তাঁরা !
ইরাবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাশুড়ি মা আবার বলে ওঠেন ,
” খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন এখনও ? সাধে কি অজয় এত রাগ করে ! যাও, নিজের খাবার নিয়ে এসো ! বিকেলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে , মনে নেই নাকি ! “
খিদে তো কখন মরে গেছে ! থালায় ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে ইরাবতী। ভেতরটা জ্বলছে ওর । আর কদিন বাদেই মা হবে ও , কেউ একজন আসবে একেবারে ওর নিজের হয়ে। একজন কাছের মানুষ পাবে ইরাবতী , যার কাছে নিজের যন্ত্রণা গুলো উপুড় করে দিয়ে হালকা হতে পারবে ও একটু ।
কিন্তু যদি ছেলে হয় ! সে তো বাবার মতই হবে ! না না , ছেলে চায় না ইরাবতী । তীব্র ঘৃণায় মুখ বেঁকে যায় ওর । মনে মনে আকুল প্রার্থনা করে ,
” হে ঈশ্বর ! আমার যেন ছেলে না হয় । এমন বাবার ছেলে চাই না আমি ! আমার যেন ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। যে হবে আমার সবচেয়ে কাছের জন। আমার দুঃখ গুলো যে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে। আমাকে মেয়ে দাও ঠাকুর ! মেয়ে দাও ! “
নোনতা চোখের জল গাল ভিজিয়ে দেয় ওর । সেদিকে তাকিয়ে শাশুড়ি বলেন , ” মেয়েদের একটু সহ্য করতেই হয়। অজয়ের মুখের ওপর কথা বল কেন বাপু ! এখন কেঁদে কি লাভ ? নাও , খেয়ে নাও ! “
” আমার ছেলে না মেয়ে হয়েছে ডক্টর ? “
এতক্ষণের ধকলে শ্রান্ত ,ক্লান্ত ইরাবতী কোনোমতে প্রশ্ন করে ডাক্তারকে । তিনি হেসে বললেন ,
” ছেলে হয়েছে আপনার ! ভয় নেই , মেয়ে হয় নি ! “
হতাশায় চোখ বুজল ইরাবতী । বুঝল , ডক্টর ভেবেছেন , পরিবারের কেউ হয়তো মেয়ে চায় না তাই ভয় পাচ্ছে ইরাবতী , তাই তিনি অভয় দিলেন ওকে । কিন্তু ইরাবতী তো মেয়েই চেয়েছিল । হে ভগবান ! এ কি করলে তুমি ! এই ছেলে কি বুঝবে মায়ের দুঃখ ! আর কোথাও যাওয়ার জায়গা রইল না ইরাবতীর ।
পনেরো দিনের বাচ্চার গলায় কি জোর ! কেঁদে বাড়ি মাথায় করছে একেবারে। ইরাবতী তবু কোলে তুলে নিচ্ছে না ওকে । এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । অসুরের ছেলে তো অসুরই হবে । অজয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণায় এই ছোট্ট শিশুকেও নিজের শত্রু বলে মনে হয় ইরাবতীর ।
অজয় এই মুহূর্তে ঘরে ঢুকে ইরাবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড ক্রোধে এক লাথি দিয়ে বলে ,
” কাঁদছে , শুনতে পাচ্ছিস না ! বাচ্চা কিভাবে মানুষ করতে হয় , সেটাও শিখিয়ে দিতে হবে নাকি ! শালী , মা হয়েছে দেখো ! “
ইরাবতী গিয়ে ওকে কোলে তুলতে যেতেই অজয় কেড়ে নিল ছেলেকে। চেঁচিয়ে মাকে ডেকে বলল ,
” মা ! এই কুত্তি তো ছেলে মানুষ করতেও জানে না ! তুমি সামলাও দেখি নাতিকে ! “
শাশুড়ি এসে নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বললেন ,
” কি গো তুমি ! কখন থেকে ও কাঁদছে ! খিদে পেয়েছে ওর , বুঝতে পারছ না ! নাও , দুধ খাওয়াও দেখি !”
শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল ইরাবতী । এই নরকে সে এতদিন ধরে বেঁচে আছে কিভাবে , সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার । পান থেকে চুন খসলেই ভয় , উঠতে ভয় , বসতে ভয়। ভয় পেতে পেতে বাঁচতেই ভুলে যাচ্ছে ইরাবতী । কখনও কি এই নরক থেকে উদ্ধার পাবে না ও !
মায়ের থেকে বেশী ঠাকুমার কাছেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে দেবমাল্য। এ বছরে ক্লাস টেন হল ওর । কথা কম বলে। খুব গম্ভীর স্বভাবের ছেলে । ওর বয়সের তুলনায় যেটা বেমানান।
ইরাবতীর সঙ্গে দেবমাল্যর তেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি । কিছুটা ইরাবতীরই জন্য , আর কিছুটা অজয় আর ওর মায়ের জন্য। ছেলেকে ভালো করে বুঝতেও পারে না ইরাবতী , এত কম কথা বলে ও , বুঝবেই বা কি করে !
একটা মেয়ে হলে এতদিনে ইরাবতীর কত কাছের হয়ে উঠত , বড় আফসোস হয় ইরাবতীর । এই অপমানের জীবন থেকে বুঝি মুক্তি নেই ওর ।
স্কুল আর টিউশন থেকে ফিরেই ছেলে গম্ভীর ভাবে ভাত খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় । পড়াশোনা করে অনেক রাত পর্যন্ত ।
আজ ছেলে ভাত খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যেতে ইরাবতী একটু পরে রাতের খাওয়ার জন্য ভাত বসিয়ে এসে একটু শুয়েছিল । কখন চোখ লেগে গেছে বলতেই পারে না। ঘুম ভাংল অজয়ের চেঁচামেচিতে । ভাত পোড়া গন্ধে ভরে গেছে বাড়ি । সর্বনাশ ! ধড়মড় করে উঠে বসল ও । অজয় চেঁচিয়েই চলেছে ,
” এতোগুলো ভাত পুড়ে ছাই হয়ে গেল । মহারাণী ঘুমুচ্ছে ভাত বসিয়ে রেখে ! তোর বাপের বাড়ি থেকে খাওয়ার টাকা দেয় ! এতোগুলো ভাত নষ্ট হল , তোর হুঁশ নেই ! ষ্টুপিড কোথাকার ! “
” বলতেই পারি না , কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ! আমি এক্ষুনি আবার ভাত বসিয়ে দিচ্ছি। ” আমতা আমতা করে বলল ইরাবতী ।
” ঘুম ! দাঁড়া , তোর ঘুম বের করছি ! এক থাপ্পড়ে সব ঘুম উড়ে যাবে তোর এখুনি। “
থাপ্পড় মারতে হাত তোলে অজয়। চোখ বুজে ফেলে ইরাবতী । সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত এসে চেপে ধরে অজয়ের উদ্যত হাতখানা। হিসহিস করে বলে ,
” খবরদার ! আর একবারও যদি মায়ের গায়ে হাত তুলেছ তো পুলিশের কাছে যাবো আমি ! অনেক সহ্য করেছি , আর নয় ! “
ইরাবতী চোখ খুলে ছেলের রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। চোদ্দ বছরের ছেলের চোখে কি ক্রোধ আর ঘৃণা ! এই ছেলে কোথায় ছিল এতদিন !
ছেলে তখনও বলে চলেছে ,
” সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি , মায়ের সঙ্গে বিনা কারণে খারাপ ব্যবহার কর তুমি ! ঘেন্না লাগে আমার , এই বাড়িতে আমি জন্মেছি বলে। তোমার টাকায় আমাকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে বলে। কোনোমতে নিজের পায়ে দাঁড়ালেই আমি মাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো ! এ বাড়িতে থাকব না আমি ! “
গোলমালে অজয়ের মা বেরিয়ে এসেছেন। তিনি বলে ওঠেন ,
” বাবার সাথে কিভাবে কথা বলছিস তুই দেবু ! “
” তুমি চুপ কর ঠাম্মা ! একটা মেয়েমানুষ হয়েও আমার মায়ের অপমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছ তুমি প্রতিদিন ! একবারও প্রতিবাদ কর নি ! তোমাকেও ঘেন্না করি আমি ! বাবা যদি আর একবারও মায়ের গায়ে হাত দেয় , বাবার হাত ভেঙ্গে দেবো আমি ! তারপর পুলিশের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলব। “
রাগে ফুঁসছে দেবমাল্য। অজয় আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছেলের দিকে। ইরাবতী কেঁদে ফেলল শব্দ করে। দেবু বিরক্ত হয়ে বলল ,
” কাঁদছ কেন তুমি ! প্রতিবাদ করতে পারো না ! এত ভয় কিসের তোমার ! আর ভয় পাবে না । আমি আছি তো ! “
ইরাবতী জানে , এই কান্না আনন্দের কান্না। ছেলে ওর কাছে আছে। আর ভাবনা কি ! এতদিনের অসম্মানের জীবন থেকে মাকে মুক্তি দেবেই দেবমাল্য। ইরাবতীর ছেলে , ইরাবতীর কাছের জন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদেই চলে ইরাবতী ।
কলমে – #মাধবী_ভট্টাচার্য
Article Comments