Bengali short story

কর্মফল

মোহন আজ তিন মাস বাড়িতে বসে। কাঠের কাজ করত মোহন। হঠাৎ মাচা থেকে পড়ে কোমরে চোট পায়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হবে না। হলেও অনেক খরচ। এই তিন মাস বাড়িতে যে কী করে রান্না হয় সে মিনতিই জানে। মুদির দোকানে বিস্তর দেনা। বাকিতে দেয় না। ছেলে নয়ন ক্লাস নাইনে পড়ে। মাস্টারমশাই রাখা তো দূর স্বপ্ন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে কোনও কাজে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু যদি পড়ে কিছু একটা করতে পারে।

― “কী গো ওঠো দেখি…খেয়ে আমায় ছাড়ান দাও। আমার গুচ্ছের কাজ পড়ে আছে।”
― “হ্যাঁ রে মিনু রোজ রাঁধিস কেমনে ? ঘরের কী হাল আমি জানি। বাবুর বাড়ির মাইনে আগাম এনেছিস নাকি ?”
― “না আগাম দেবে না। রাতে রায়বাবুর দোকানে বসি যাতে রতন রাতে চুরি করতে না পারে। রতনকে দেখার জন্যই রায়বাবু রেখেছে। প্রতিদিন দশ টাকা করে দেয়। আর সকালে ছেলেটাকে নির্মলের চায়ের দোকানে বসিয়েছি। এইভাবে কোনওরকম চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া ঠোঙা বানাই। এইভাবে চালাচ্ছি। যদি তোমার চিকিৎসাটা করতে পারি।”
― “তোরা এত কাজ করছিস, হা ভগবান আমার মরণ হয় না কেন ? আমার জন্য এত খাটাখাটনি, ছেলেটাও বাদ গেল না !”
― “আহা এরকম বোলো না, অভাবের সংসারে এসব তো হবেই।” পিঠে বালিশ গুঁজে কোনওরকম খাওয়াল মোহনকে।
― “ওই রায়বাবুর থেকে সাবধান থাকিস মিনু, ও যা লোক !”

সেটা মিনু প্রথম দেখেই বুঝেছে তাই ওর কোনও প্রলোভনে পা দেয়নি। রায়বাবু অনেক লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু মিনুও তেমন বাঘা তেঁতুল। ওর ছেলে নয়ন আর রায়বাবুর ছেলে দেবাশিস একই ক্লাসে পড়ে। ওদের দু’জনের তেমন একটা বন্ধুত্ব নেই। যেমনটা হয় গরিব আর বড়লোকের মধ্যে। নয়নকে করুণার চোখে দেখে। একটু আধটু সাহায্য করে।
সেদিন দুপুরে মিনতি দোকানে বসে আছে হঠাৎ ভেতর থেকে ধপ করে আওয়াজ আসে। রতনও নেই দোকানে। মিনতি ছুটে যায় ঘরে, হঠাৎই ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মিনতি চিৎকার করে, “বাঁচাও আমাকে…বাবু এমনটা করবেন না…” আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়ানোর; কিন্তু পারে না। অবশেষে হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে শুনতে পায়, “মা তুমি কোথায় ?”
“যেই অমনি বাগে পেয়েছি সেই আসতে হল হারামজাদাটাকে…কোনও মতেই দরজা খুলব না” – গরজায় রায়বাবু। হঠাৎ প্রবল ধাক্কায় দরজা খুলে যায়। এক হাতে বাটখারা নিয়ে দাঁড়িয়ে নয়ন। নয়ন রায়বাবুকে মারতে যাবে, তখনই আচমকা কেউ যেন ওর হাত থেকে বাটখারাটা কেড়ে নেয়। উপর্যুপুরি আঘাত করে রায়বাবুকে। কখন যে দেবাশিস এসে দাঁড়িয়েছিল কেউ খেয়াল করেনি।

“তুই তোর মা’কে নিয়ে বাড়ি যা নয়ন। তোর মা মানে আমারও মা।” বলে ওঠে দেবাশিস, “ছি…ছি…এই লোকটাকে নিজের বাবা বলতেও ঘেন্না করে।”
নয়নের মা’কে শাড়ি দিয়ে ঢেকে বার করে আনে দেবাশিস। মা’কে নিয়ে বাড়ি ফেরে নয়ন।
নয়ন সন্ধেবেলা গণেশদার চায়ের দোকানে গিয়ে পুরো ঘটনাটা শোনে। দেবাশিস নাকি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে রায়বাবুকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। নয়ন আশ্চর্য হয় এই শুনে যে খুনের কারণ হিসেবে দেবাশিস বলে, ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় সে খুন করে তার বাবাকে।
থানায় নয়ন দেখা করতে গেলে দেবাশিস বলে, “বদনাম আগুনের মতো ছড়ায়, আমি আমার বাবাকে বদনামের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছি। তুই তোর মা’কে বদনাম করিস না। বাবার হয়ে শাস্তিটা না হয় আমিই পেলাম। পারলে কাকিমাকে বলিস ক্ষমা করে দিতে।”
নয়ন আজ বুঝল – পার্থক্যটা হল মানসিকতার, টাকা দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না।

#কলমে – প্রিয়াঙ্কা মিশ্র

Share With Friends

Article Comments

Scroll to Top