কি গো বৌমা, তোমার লুচি ভাজা হলো? বেগুনের মাঝের পিসগুলো ওদের জন্য রেখো।
আরে সোনালী,রূপালী ফোন করেছিল ..
ওরা এখুনি এসে যাবে। এমনিতেই এত বেলা পর্যন্ত উপোষ করা ওদের ধাতে নেই।
শাশুড়ীমা বেলাদেবী একটু আদুরে গলায় বললেন, আসলে আমার দুই মেয়েই বড্ড আদরে মানুষ কিনা! আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও আদরেই আছে। কুটোটি নাড়তে হয়নি কোনোদিন। সবই আমার মেয়েদের সোনার কপালে হয়েছে। তুমি তো জানো… আহা, ক্ষিদে ওরা মোটে সইতে পারে না।
রিনিতা আলুরদমে গরমমসলা মেশাতে মেশাতে সকলের অলক্ষ্যে চোখের জল মুছলো।
হ্যাঁ মা, আমার কাজ প্রায় শেষ। ওরা এলেই আমি থালা সাজিয়ে দেবো।
নবেন্দু কোথায় গেল বৌমা? ও স্নান করে পাঞ্জাবী পরে রেডি তো?
নবেন্দু রিনিতার স্বামী। এবাড়ির একমাত্র ছেলে। রিনিতার মাত্র বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। সোনালী রিনিতার বড় ননদ, রূপালী ছোট। যদিও দুজনেই রিনিতার থেকে বছর পাঁচ-ছয়ের বড়। নবেন্দুর দুই দিদি।
এ বাড়ির দুই আদরের মেয়ে।
ভাইফোঁটার দিনে তারা তাদের একমাত্র ভাইকে ফোঁটা দিতে আসবে বলেই সকাল থেকে রিনিতা রান্নাঘর থেকে বেরোনোর ফুরসৎ অবধি পায়নি। নবেন্দুর দুই মামাও আজ আসবে বেলাদেবীর কাছে ফোঁটা নিতে। বাড়ি একেবারে জমজমাট।
গতবছর রিনিতার ভাইও এসেছিল এবাড়িতে। রিনিতার বাপের বাড়ির অবস্থা সত্যিই খারাপ।
বাবা সেই ছোটবেলায় মারা গেছেন। মায়ের একটা ছোট্ট টেলারিংএর দোকান। ভাই এখনো চাকরি পায়নি। রিনিতাই বলেছিল, ভাই তুই ফাঁকা হাতে চলে আসবি। পাকামি করে কিছু কিনতে যাবি না যেন।
রিনিতা ভাবতেও পারেনি, ওর ভাইয়ের এই ফাঁকা হাতে আসা নিয়ে এবাড়ির সকলের এত ব্যঙ্গ শুনতে হবে।
সোনালীদি, রূপালীদির জন্য মা রীতিমত দামি দামি উপহার কিনেছিল, ওরাও নবেন্দুর জন্য মূল্যবান উপহার এনেছিল। শুধু রিনিতার ভাই শুভই এসেছিল একটা সস্তার সুতির ছাপা নিয়ে।
ভাইফোঁটা মিটে যাবার পর, ড্রয়িংরুমে রীতিমত সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
ছি ছি কি হাঘরে বাড়ির মেয়ে নিয়ে এসেছে নবেন্দু পছন্দ করে, এই যাদের রুচি!!
নবেন্দুও রাতে ঘরে ঢুকেই বলেছিল, আরে আমাকে বললেই তো পারতে, তোমার মায়ের দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাহলে আমিই নাহয় লুকিয়ে একখানা কিছু কিনে আনতাম।
শুভটাও হয়েছে অপদার্থ। খেলা খেলা করে জীবন কাটাচ্ছে। একটা চাকরিও জোগাড় করতে পারলো না।▪
কষ্ট হয়েছিল রিনিতার। কিছুতেই বুঝতে পারেনি ভাইফোঁটা আসলে কিসের উৎসব!!
ভাইয়ের মঙ্গলকামনার, নাকি দামি উপহার দেবার!
এবারে আগে থেকেই মাকে ফোন করে বারণ করে দিয়েছে রিনিতা, মা যেন শুভকে না পাঠায়।
এই প্রথম তার ভাইটাকে ফোঁটা দেওয়া হবে না। ছোট থেকে এই দিনটায় মা লুচি বেলে মিষ্টি সাজিয়ে দিত থালায়, আর শুভ সকাল সকাল স্নান করে আসনে বাবু হয়ে বসে বলতো, দিদি, এই মিষ্টির থালার মিষ্টিগুলো আমাদের দুজনের। তুই আমার ফোঁটা দিবি তাই তোর, আর আমার কপালে ফোঁটা থাকবে তাই আমার।
রিনিতা হাসিমুখে বলতো,বেশ এখন শান্ত হয়ে বস। শুভ দিদির মুখে মিষ্টি না খাইয়ে কোনোদিন ভাইফোঁটায় খাবারে হাত দেয় নি এতকাল। এবারই তার ব্যতিক্রম হবে।
কাজ করতে করতে বারবার চোখে জল এসে যাচ্ছিল রিনিতার।
নবেন্দুর দুই মামা তো শাশুড়ী মায়ের জন্য প্রতিযোগিতা করে দামি গিফ্ট কেনে।
মা সেগুলো ইচ্ছে করেই বারবার রিনিতাকে দেখায়। ¤
আসলে বংশমর্যাদা জিনিসটা আলাদা, বুঝলে রিনিতা। ওটা সকলের পরিবারে থাকে না। বলেই মা বললেন, তা শুভকে এবারে আসতে বারণ করেছো বুঝি?
শুভটা এত খেতে ভালোবাসে। আজ তো বললেই পারতে। এই বাড়িতে আজ এত রকম রান্না হচ্ছে, রোজ রোজ তো সিদ্ধ ভাত খেয়েই থাকে বেচারি। একদিন না হয় বড়লোক দিদির বাড়ি এসে পেট পুরে খেয়ে যেত।
কথাগুলো বলার সময়েই বেলাদেবীর ঠোঁটের ফাঁকের অবজ্ঞার হাসিটা চোখে পড়লো রিনিতার।
না মা, শুভ আজ থাকবে না। ওর আজ রঞ্জি ট্রফির ক্রিকেট টিমে সিলেকশনের ব্যাপার আছে।
বাড়ি শুদ্ধু সকলে একসাথে হেসে বললো, কি ? গরীবের ঘোড়া রোগ আর কি…
তোমার ভাই খেলবে ক্রিকেট টিমে? পাড়ার ক্রিকেট আর এই খেলা কি এক হলো?
গরিবরা কি স্বপ্নও বেশি দেখে নাকি?
নবেন্দুর দুই দিদির গাড়ি ঢুকলো।
রিনিতা ছুটলো রান্নাঘরের দিকে, সব গোছানোই আছে। একমুহূর্ত দেরি করলেই আবার কথা শুনতে হবে।
শ্বশুরমশাই ঘরে নিউজ চ্যানেল চালিয়েছে।
দুটো থালায় লুচি তরকারি,মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে যেতে যেতেই টিভিতে শুনতে পেল….বাড়ুইপুর থেকে রঞ্জি ট্রফির টিমে নির্বাচিত হয়েছে শুভায়ু দেবনাথ।
রিনিতা থালা দুটো টেবিলে নামিয়েই ছুটে টিভির সামনে গিয়ে দেখতে পেল শুভর হাসি হাসি মুখটা টিভির পর্দায়।
হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে শাড়ি পরে রেডি রিনিতা। শাশুড়ী মা বললেন,ওমা বৌমা..তুমি কোথায় চললে। আমার ভাইয়েরা এখুনি এসে পড়বে।
রিনিতা স্পষ্ট গলায় বলল, আমি নিরুপায় মা..
আজকের দিনে আমাকে আমার অপদার্থ ভাইটার কাছে একবার পৌঁছাতেই হবে। ওকে ফোঁটা না দিলে ওর আগামী দিনগুলোয় ওর পাশে থাকবো কি করে? গরিবের ঘোড়া রোগকে সার্থক করে ও নিশ্চয় ইন্ডিয়া টিমেও খেলবে একদিন। তাছাড়া আমি রাত পর্যন্ত ওর কল্যাণের জন্য উপোষ করতে পারি, অত আদরের মেয়ে নই কিনা! আর মূল্যবান উপহারের বিচারে আমি আমার ভাইকে ফোঁটাও দেব না মা। ¤
সোনালীদি বললো, সেকি রিনি…তুই চলে গেলে মাংস, মাছ ,পোলাও সব রাঁধবে কে?
রিনিতা বললো, কেন দিভাই তোমাদের ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য তোমরাই নাহয় একদিন হাত পুড়িয়ে ভাইকে রান্না করে খাওয়ালে!
সকলের থমকে যাওয়া মুখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে এলো শুভায়ু দেবনাথের দিদি।
রিনিতা নিজেও জানে না এতটা জোর ওর কোথায় ছিল!! শুধু শুভর এই সাফল্যই হয়তো রিনিতাকে মুখের কথা জোগালো তার অপদার্থ ভাইয়ের পরিচয় সকলের সামনে দিতে পেরে। এতদিনে ভালো বৌ হবার প্রতিযোগিতা থেকে নিজের নামটা মুছে দিতে পারলো রিনিতা। নিজের চাওয়া, পাওয়াগুলোকেও যে গুরুত্ব দিতে হয় এতদিনে বুঝলো ও।
বাড়ির বাইরে এসে একটা জোরে নিঃশ্বাস নিলো। ফিরে এসে হয়তো আরও বড় অশান্তি হবে এ বাড়িতে, কিন্তু এবারে ও মাথা তুলে শিরদাঁড়া সোজা করেই বাঁচবে।
কলমে – অর্পিতা সরকার
Article Comments